টানা পাঁচ মাস বন্ধ খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)’র শিক্ষা কার্যক্রম। এ নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন এবং হতাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়ে পাঁচ সহস্রাধিক শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা। শিক্ষার্থীরা অস্থির ক্লাসে ফিরতে। ইতিমধ্যে ২১ জুলাই থেকে কয়েকটি বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্লাসে বসে প্রহর গুণছেন শিক্ষকদের ক্লাসে ফিরে আসার।
কুয়েট গার্ডিয়ান ফোরাম দ্রুত একাডেমিক কার্যক্রম শুরুর দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে মানববন্ধন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি’র) চেয়ারম্যান ও শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর স্মারক লিপি প্রদান করেছেন। শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের সাথেও সাক্ষাৎ করে ক্লাস শুরুর দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার বিষয় নিয়ে রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ‘র সাবেক সচিব ও চেয়ারম্যান ড. মোঃ আবদুল মজিদকে প্রদান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
সর্বশেষ ২১ জুলাই শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায়ও উপস্থিত শিক্ষকদের অধিকাংশ ক্লাস শুরুর ব্যাপারে সম্মতি প্রকাশ করেছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সবাই উপস্থিত একজন শিক্ষক নিশ্চিত করেছেন।
সব মিলিয়ে শিক্ষক সমিতির উপর চাপ বাড়ছে দ্রুত শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে। কিন্তু শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ শুরু থেকেই ভিসি নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত ক্লাসে না ফেরার ব্যাপারে অনড় অবস্থানে রয়েছে। এর নেপথ্যের কারণ অজ্ঞাত।
সোমবার (২১ জুলাই) শিক্ষক সমিতির নবম সাধারণ সভায় উপস্থিত ১৫/২০ জন সিনিয়র শিক্ষকসহ অধিকাংশ শিক্ষক ক্লাসে ফিরে যাওয়ার সম্মতি প্রকাশ করেন। কিন্তু সমিতির কয়েকজন শিক্ষক সেটি খন্ডন করে একটি মতৈক্যে উপনীত হন, সেটি হল শিক্ষকদের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাথে নিয়ে একই প্লাটফর্মে থেকে প্রথমত দ্রুত ভিসি নিয়োগের ব্যাপারে জোর দাবি জানানো, দ্বিতীয়ত ভিসি নিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে ক্লাস শুরু করা হবে। তবে শিক্ষক লাঞ্ছনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের বিচারের বিষয়ে ভিসি’র কাছে উপস্থাপন করা হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাব রাখা হবে।
সভায় সমিতির চলমান কর্মসূচি স্থগিত বা ওই কর্মসূচির কার্যকারিতা নেই বলা হয়। সমিতির সাধারণ সম্পাদকের ভাষ্য অনুযায়ী যদি সমিতির দেওয়া কর্মসূচি বহাল না থাকে তাহলে ক্লাসে ফিরতে শিক্ষকদের আর কোন বাধা থাকার কথা নয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সভায় উপস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন। টানা সাড়ে তিন ঘন্টা চলা ওই সভায় ভিসি নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত ক্লাসে ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে সমিতির অনেক শিক্ষক দ্বিমত পোষণ করেন।
সমিতির সিদ্ধান্তে আন্দোলন চলমান আছে কি/না এমন এক প্রশ্নের জবাবে একটি গণমাধ্যমে দেওয়া সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. মোঃ ফারুক হোসেন বলেন, ‘যখন থেকে উপাচার্য নেই, তখন থেকেই কার্যত আন্দোলন কর্মসূচি কার্যকর নেই। আমাদের কর্মসূচির মাঝে উপাচার্য চলে গেছেন। দাবিটা ছিল তার কাছে। সুতরাং এটার কার্যকারিতা হারিয়ে গেছে।’
সমিতির সাধারণ সম্পাদকের ভাষ্য অনুযায়ী যদি আন্দোলনের কর্মসূচি স্থগিত বা কার্যকারিতা না থাকে তবে ক্লাশ হবে কি, হবে না? এ সিদ্ধান্ত শিক্ষক সমিতি বা সমিতি নিতে পারেন কিনা ? এবং এ জাতীয় সিদ্ধান্ত সমিতির নেওয়ার এখতিয়ার আছে কিনা? এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয় বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)’র সদস্য (প্রশাসন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত) ও ইউজিসি কর্তৃক গত এক বছরে কুয়েটে বিধি বহির্ভূত নিয়োগ এবং বিভিন্ন মাধ্যমে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অধ্যাপক ড. মোঃ সাইদুর রহমানের কাছে। তিনি খুলনা গেজেটকে বলেন, ‘এ জাতীয় কোন এখতিয়ার সমিতির নেই। কারণ সর্বশেষ ৪ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিক্ষকরা যে কোন সময় ক্লাস নেওয়া শুরু করতে পারেন। ভিসি থাকা বা না থাকা, ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারে এটা কোন বাধা নয়। ইতিমধ্যে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে উপস্থিত হতে শুরু করেছে। এখন শিক্ষকদের ক্লাস নিতে হবে।’
তদন্ত কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমরা কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে তদন্তের কার্যক্রম শুরু করেছি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একজন সিনিয়র শিক্ষক বলেন, ‘একজন শিক্ষক হিসেবে আমি সমিতির সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারি না। আমার ব্যক্তিগত মতামত যদি চান সে ক্ষেত্রে সেক্ষেত্রে বলব, শিক্ষকদের আর রাগ না করে, সময় প্রলম্বিত না করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়ে পাঁচ সহস্রাধিক সাধারণ শিক্ষার্থীর কথা বিবেচনা করে আমাদের উচিত ক্লাসে ফিরে যাওয়া। ছেলে মেয়েদের আমি বলেছিলাম, তোমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় শিক্ষকদের কাছে ক্ষমা না চেয়ে সরাসরি ডীন অথবা ডিপার্টমেন্টের প্রধানদের সাথে যোগাযোগ করে শিক্ষকের একত্রিত করে তাদের কাছে ক্ষমা চাও। তাহলে সমস্যা হয়তো এত দূর সামনে এগোতো না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান অচলাবস্থা সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভিসি প্রফেসর ড. শেখ শরীফুল আলম বলেন, ‘একজন শিক্ষক এবং প্রাক্তন প্রশাসক হিসেবে আমি মনে করি, দীর্ঘ পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এখন সময় এসেছে একাডেমিক কার্যক্রমে ফিরে যাওয়ার। আমাদের শিক্ষার্থীরা ও তাদের পরিবার দারুণ অনিশ্চয়তায় রয়েছে। তদ্ব্যতীত, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক সংস্থা (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়) থেকে পরামর্শ এসেছে যে, ক্লাস-পরীক্ষা চালু করা হলে ভিসি নিয়োগ প্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে। যেহেতু নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান এবং কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিয়েছেন, তাই আমাদেরও দায়িত্বশীল আচরণ করে ক্লাসে ফিরে যাওয়া উচিত।
তবে শিক্ষকদের ক্লাসে ফেরার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের হল ও ক্যাম্পাসে উপস্থিতিও নিশ্চিত করা জরুরি। শিক্ষার্থীরা যদি ক্যাম্পাসে না থাকে, তাহলে শিক্ষকদের এককভাবে দায়ী করা কিংবা ক্লাস না নেয়ার অভিযোগ যথার্থ হয় না।
তিনি আরও বলেন, একটি প্রশ্ন প্রকটভাবে উঠছে-সরকার কেন এখনো একজন যোগ্য ও দক্ষ উপাচার্য বা প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারছেন না? একটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘ সময় ধরে উপাচার্যবিহীন থাকা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতে করে পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।
সবশেষে তিনি বলেন, উল্লিখিত অভিমত সম্পূর্ণরূপে আমার ব্যক্তিগত। সমিতির কোনো সিদ্ধান্ত নির্ধারণের দায়িত্ব কার্যনির্বাহী কমিটির ওপরই ন্যস্ত থাকা উচিত।’
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যকার অসন্তোষের কারণে উদ্ভূত অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ও শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সচিব ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মজিদকে আহবায়ক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রাব্বানী মন্ডল ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. মাসরুর আলীকে সদস্য করে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
২০ জুলাই মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগের (বৃত্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা)’র সিনিয়র সহকারী সচিব এ এস এম কাসেম ওই প্রজ্ঞাপনে স্বাক্ষর করেন।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়-
১. চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে হবে।
২. শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার কারণ উদঘাটন এবং সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা চিহ্নিতকরণ।
৩. প্রজ্ঞাপন জারির দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগ বরাবর দাখিল করতে হবে।
৪. বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার নিশ্চিন্তের মাধ্যমে নিরবিচ্ছিন্ন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সুপারিশ প্রদান করতে হবে।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান অচলাবস্থা নিরসন এবং দ্রুত শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার জন্য অনতিবিলম্বে ভাইস-চ্যান্সেলর নিয়োগের দাবিতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকবৃন্দের যৌথ মানববন্ধন আজ বুধবার বেলা ১১ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্বার বাংলা চত্বরে অনুষ্ঠিত হবে বলে শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছে।
খুলনা গেজেট/লিপু/এনএম